চারপাশে নদী। দিগন্ত পর্যন্ত জলরেখা। মাঝে ভাসছে কিছু কাঠের তৈরি বড় বড় নৌকা—নদীর বুকেই যেন একেকটা ছোট্ট গ্রাম। এগুলোই মান্থা জেল—জেলে নারীদের ভাসমান বন্দীশিবির।
জেলখানার ধারণা মানেই ইট-পাথরের প্রাচীর, কাঁটাতার, পাহারাদার। কিন্তু এই মান্থা জেলে এসবের কিছুই নেই। এখানে জেল মানে একটা নৌকা—একটা কাঠের খোলের ঘর, যেখানে ৮-১০ জন নারী পাশাপাশি থাকে। নৌকাই তাদের ঘর, ওটাই বিছানা, ওটাই রান্নাঘর, আবার ওটাই শাস্তির জায়গা।
দিন শুরু হয় নদীর জলে
ভোর হতে না হতেই নদীর হাওয়া গায়ে এসে লাগে। ঘুম ভাঙে নারীদের। কেউ জেগে বসে থাকে চুপচাপ, কেউ নামাজ পড়ে, কেউ আবার কাঁথার নিচে মুখ গুঁজে থাকে আরও কিছুক্ষণ। নৌকার এক কোনায় রাখা মাটির হাঁড়িতে রাতের পানি—সেই পানি দিয়েই মুখ ধোয়া, দাঁত মাজা। টয়লেট বলতে একটা কাঠের পাতার ঘের দেওয়া ছোট্ট জায়গা, নৌকার পেছনে ঝুলে থাকে নদীর ওপরে।
রান্না, সেই একঘেয়ে লড়াই
নৌকার মাঝখানে একটা ছোট্ট চুলা, কাঠ বা কয়লার। সেখানে একজন করে রান্না করে, অন্যরা বসে আলু ছাঁকে, ডাল বেছে। মেনু সাধারণত একরকম—ভাত, ডাল আর কখনো তেল-মরিচে ভাজা কিছু শাকসবজি। মাংস আসে মাসে একবার, কখনো না-ও আসে।
রান্নার পর ভাগাভাগি—কার কতটুকু খাবার, কার পাতে একটু বেশি, এসব নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়া বাঁধে। আবার তারাই মিটেও যায়, কারণ জায়গা কম, জীবন সংকুচিত—ঝগড়া জমিয়ে রাখলে চলবে না।
সারাদিনের জীবন—ঘোরের মধ্যে বাস্তবতা
বেশিরভাগ সময় কাটে বসে বসে—কারও হাতে সুতো, কেউ পুরনো শাড়ি ছিঁড়ে কাঁথা তৈরি করছে, কেউ চুপচাপ বাইরের জলপথের দিকে তাকিয়ে। কেউ কেউ বই পড়ে—যা মাঝে মাঝে দান করে কেউ বা সংগঠনের লোক দিয়ে আসে। জেলের নিয়মে কেউ কেউকে চিঠি লিখতে পারে, মাসে একবার দেখা করতে পারে পরিবারের কেউ। তবে সবার ভাগ্যে তা জোটে না।
রাত—জেলের নীরবতা আরও গভীর
রাতে নৌকার ভেতর ঠাসাঠাসি করে শোয়া। কাঠের মেঝেতে পাতলা চট, তার ওপর চাদর। বাতাসে ভেসে আসে দূরের স্টিমারের হর্ন। নদীর কুয়াশা ঘিরে ধরে পুরো জেলটাকে। আলো বলতে একটা কুপি বা সোলার লাইট, যা সবাই মিলে ভাগ করে নেয়।
ঘুম আসে না সবার। কেউ স্মৃতি মনে করে কাঁদে, কেউ চোখ খুলে রাত চেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কারও জ্বর হয়, কারও বাচ্চা পেটেই মারা যায়—চিকিৎসা অপ্রতুল, নদীর মাঝে হাসপাতাল তো নেই।
বাহিরের জগৎ, ভিতরের আশাভাঙা
মান্থা জেলে যারা আছে, তারা কেউ নিছক অপরাধী না। কেউ দারিদ্র্যের কারণে মানবপাচারের ফাঁদে পড়ে, কেউ আবার স্বামীর করা অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে, কেউ কেবল প্রতিবাদ করেছিল বলেই ঠাঁই হয়েছে এই নৌকা-জেলে।
তাদের বিচার চলতে থাকে বছরের পর বছর, কাগজে নামে দাগ, অথচ কণ্ঠে নিজের কথা বলার অধিকার থাকে না।
একটা জীবন, যা নদীর মতো বয়ে যায়, অথচ কোথাও গিয়ে থামে না।
মান্থা জেল তাই শুধু জেল না—এটা এক বন্দী জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি। নৌকার দুলুনিতে প্রতিদিন তারা যেন এক নতুন দিন পার করে, কিন্তু প্রতিদিনই একই থেকে যায়। সেই জেল থেকে বের হবে কেউ কেউ—তাদের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন এক সমাজ, যেটা অনেক সময় জেলের থেকেও কঠিন।