বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নদীর বুকে ভেসে থাকা এক অনন্য জনগোষ্ঠীর নাম মান্তা সম্প্রদায়। নৌকাই তাদের ঘর, নৌকাই আশ্রয়, আর নৌকাতেই জন্ম থেকে মৃত্যু—এই ভাসমান জীবনই তাদের শতাব্দীর পর শতাব্দীর বাস্তবতা।

নদীর বুকে জীবনের কষ্ট মান্তাদের কোনো জমি নেই, নেই স্থায়ী বসতি। ছোট ছোট নৌকাই তাদের বসতবাড়ি। নদীর ঢেউ, ঝড়-বন্যা কিংবা খরস্রোতের সঙ্গেই তাদের প্রতিদিনের লড়াই। পুরুষরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে, আর নারীরা সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। অনেক সময় নারী-পুরুষ সমানভাবে নদীতে নেমে মাছ ধরে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের জীবন সবসময় হুমকির মুখে থাকে।

শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশুরা মান্তা শিশুদের সবচেয়ে বড় অভাব হলো শিক্ষা। নৌকায় ভেসে থাকার কারণে তারা বিদ্যালয়ে নিয়মিত যেতে পারে না। অনেকে অক্ষরজ্ঞানহীন থেকে যায়। যদিও তারা পড়াশোনা করতে চায়, কিন্তু নদীর ভাসমান জীবনের কারণে সেই স্বপ্ন পূরণ হয় না।

নারীর সংগ্রাম মান্তা নারীরাই সংসারের বড় দায়িত্ব নেয়। তারা শুধু মাছ বিক্রিই করে না, বরং অনেক সময় নৌকা বাইতেও দেখা যায়। তবে জীবনের নিরাপত্তা নেই, স্বাস্থ্যসেবারও যথাযথ সুযোগ নেই। মাসিক স্বাস্থ্য, মাতৃত্বকালীন যত্ন—সবকিছুতেই তারা অবহেলিত।

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের দাবি নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলা এই জনগোষ্ঠী আসলে রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের স্থায়ী পুনর্বাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নারীদের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কার্যকর উদ্যোগ জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মান্তাদের জন্য বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে সমাজে বসবাস করতে পারে।

আশার আলো সম্প্রতি বিভিন্ন এনজিও মান্তা সম্প্রদায়ের নারীদের ক্ষমতায়ন, শিশুদের অক্ষরজ্ঞান এবং স্বাস্থ্যসেবায় কাজ শুরু করেছে। তবে তা অল্প কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। টেকসই সমাধানের জন্য প্রয়োজন সরকারিভাবে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ।

নদীর বুকে জন্ম নেওয়া এই মানুষগুলোও আমাদেরই মতো স্বপ্ন দেখে—এক টুকরো জমি, নিরাপদ আশ্রয় আর শিক্ষার আলো। রাষ্ট্র ও সমাজ যদি এগিয়ে আসে, তাহলে একদিন মান্তা সম্প্রদায়ের ভাসমান জীবনের কষ্ট হয়তো ইতিহাস হয়ে যাবে।