আমাদের দেশে একটি অত্যন্ত পরিচিত সমাজ বা গোষ্ঠী ‘মান্থা’। কিন্তু এই মান্থা সমাজের জীবন চিত্র বা জীবন যাপন সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানি না। তবে এই মান্থা সমাজের রয়েছে একটি ভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

মান্থা নারীদের জীবন সংগ্রামের দিকে চোখ রাখলে দেখতে পাওয়া যায় তাদের সংগ্রামের ইতিহাস।

মান্থা সমাজ মূলত নারী শাসিত। অর্থাৎ এ সমাজে সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় পরিবারের নারীদের দ্বারা। মান্থা সমাজের নেই কোন নির্দিষ্ট এলাকা। সময় সুযোগ বুঝে এরা বিভিন্ন এলাকায় ক্ষণস্থায়ী ভাবে বসবাস করেন তারা।

সত্যি বলতে কি, এদিকে তাদের ঠেলে দিয়েছি আমরাই। মান্থা সমাজ যা জানত, যা তাদের আয়ের পথ, তা হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মান্থা জনগোষ্ঠীতে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি কর্মঠ। সেই ভোর বেলা মাছ ধরতে বের হয়, ফিরে বিকেলে, আবার রাতেও মাছ ধরে। কিন্তু এই নারীদের স্বাস্থ্য ও সচেতনতা বেদনাহত হওয়ার মতো উপেক্ষিত। অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৪-১৫ বছরের মধ্যে।

হলুদ শাড়ি পড়ে মাঠের মধ্যে বসেছিলেন সন্তানসম্ভবা কোহিনুর। জানতে চেয়েছিলাম ঝড় এলে কোথায় থাকবেন। হাতে থাকা গাছের এক শুকনা ডাল উঁচু করে এমন এমন ভঙ্গিমায় দেখালেন , যেন প্রাসাদের সুরক্ষিত নিরাপত্তা।

অথচ ওটা বাঁশের দুটি টানা দিয়ে টাঙ্গানো একটা কালো প্লাস্টিকের ছাউনি। মাটির ওপর একটা ছেঁড়া পাটি পেতে ঘুমানোর ব্যবস্থা। মাত্র ২১ বছর বয়সী শাবনুরের তিনটি সন্তান আছে এরই মধ্যে। চতুর্থ সন্তান জন্মের সময় এমন অপুষ্টিতে ভুগছেন যে নিজেরই টিকে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে এখন।

মান্থা সম্প্রদায়ের নারীরা সন্তান জন্মের জন্য সাধারণত সদর হাসপাতালেও যায়না। তাদের অভিযোগ নার্স বা চিকিৎসকদের অবহেলা নিয়ে। নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই আছেন কয়েকজন দাই। তাদের একজন যেমন সদরপুরের তসলিমা বেগম। তিনি বলছিলেন, ওপরে আল্লাহ আর নিচে আমি। আমার হাতে যতক্ষণ রোগী আছে, জান থাকা পর্যন্ত আমি ছাড়বোনা। তসলিমা খাতুনের হাতে জন্ম নিয়েছে কয়েক’শ শিশু। তিনি এ বিদ্যা শিখেছেন তার শাশুড়ি আর দাদি শাশুড়ির কাজ দেখে-দেখে।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্টার ডা. শরিফুন্নেছা বলেছিলেন, নরমাল ডেলিভারির সময় যে নিয়মকানুনগুলো মানতে হয়, মান্থা জনগোষ্ঠীর নারীদের সেটুকু প্রশিক্ষণও নেই। এ মানুষদের জন্য আমরা মাঝে মধ্যে মেডিকেল ক্যাম্প করে হলেও মৌলিক কিছু বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। কিশোরীদের মাসিকের সময়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও কোন সাধারণ ধারনা নেই। এই অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা শুধু নারীর নিজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তা-ই নয়। একই সঙ্গে তার সন্তানের সুস্থতা নিয়েও আশংকা থাকে।

তবে স্বাস্থ্য বিষয়ে অসচেতনতা একই রকম। পোশাকে ও সাজে তারা অনিন্দ্য অথচ সেদিন দুপুরে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে দেখা গেল সতর্কতার কোন বালাই নেই। করোনা নামের অতিমারিতে যে গোটা বিশ্বের এমন পরিস্থিতি, সে খবর এতটুকু বিচলিত করেনি তাদের। চার নারী সেখানে বসে গল্প করছেন। সেখানে কিছুক্ষণ আগেই মারা হয়েছে কোন প্রাণী। উঠানের এখানে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধা, মাছি ঘুরছে ভন ভন করে। সেই পরিবেশে বসে শিশুদের থালায় ভাত মেখে দিচ্ছেন দু’জন। করোনার কথা বলতেই হেসে উড়িয়ে দিলেন। তাদের কোমরে রুপার বিছা আর হাতের বাজু বন্ধনী চমকাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সুন্দর মুখে, শরীরের ত্বকে নানা রকম ছত্রাকের বাসা।

প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সচেতন হওয়ার দায়িত্বটা উপেক্ষা করা চলেনা। সরকারি হাসপাতালে গেলে যেন চিকিৎসার মৌলিক অধিকারটুকু পায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বছরে অন্তত দু’বার করে মেডিকেল ক্যাম্প করার প্রয়োজন এই বেদেপল্লীগুলোতে।