যুগের পর যুগ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও জেলে হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি মানতা সম্প্রদায়ের নারীদের। ফলে সরকারি সহায়তা ও সুবিধার খাতায় নাম ওঠে না তাদের। এতে স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।

নদীতে ভেসে চলা এ সম্প্রদায়ের নারীরা জেলে হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলী ভাঙার পার এলাকার মানতা সম্প্রদায়ের বাসিন্দা শাহিদা বেগম (৫৫)। ৮-৯ বছর বয়স থেকেই বাবা মায়ের সঙ্গে জাল নিয়ে নদীতে মাছ ধরছেন। মাছ ধরে জীবনের ৫৫টি বছর পার হলেও এখনো মেলেনি জেলের স্বীকৃতি। এতে সরকারি কোনো সুবিধার পাচ্ছেন না তিনি।

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে শাহিদা বলেন, ‘৫৫ বছর ধইররা সূর্যো উডার আগে হইতে নৌকা নিয়ে এই কীর্তনখোলা নদীতে মাছ ধরি। এতদিন মাছ ধরছি, জাল বাইছি কিন্তু এহন পোর্যন্ত কাগজে কলমে মুই জেলে না। মহিলা হইয়া কি জেলে হওয়া যায় না?’

ছকিনা নামের আরেক নারী বলেন, ‘জন্ম হইছি নৌকায়, জীবিকাও চলে নদীতে, কিন্তু সরকার আমাগো জেলে হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। ফলে সরকারি কোনো সাহায্য সহায়তা-ভিজিএফ চাল, দুর্যোগকালীন ত্রাণ ও প্রণোদনা কিছুই পাই না।’

মানতা সম্প্রদায়ের ঝর্না ও হালিমা বলেন, মানতা সম্প্রদায়ের নারীরা বেশ কয়েক দশক ধরে নদীতে বসবাস করে মাছ ধরছেন, তাদের জীবন নদীর ছন্দে নির্ভর করে। অথচ সরকারি হিসেবে তাদের অস্তিত্ব এখনও স্বীকৃত হয়নি। মূলত নারী হওয়ার কারণেই তারা জেলে হিসেবে নিবন্ধন পাননি।

একই অভিযোগ করেন চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলী ভাঙার পার এলাকার মানতা সম্প্রদায়ের শতাধিক নারী জেলে। তারা বলেন, নারীদের জেলে হিসেবে অফিসিয়াল তালিকাভুক্ত করা, ভিজিএফ, দুর্যোগ ত্রাণ, প্রণোদনা ও স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ত সুবিধা পাওয়া, মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সহায়তা উপযোগী স্বাস্থ্যপরিচর্যায় অন্তর্ভুক্তি অবশ্যক। ভাসমান জীবিকা থেকে তাদের ভূমিকা স্বীকৃতি ও পরিপূর্ণ অন্তর্ভুক্তির নিশ্চয়তা করতে হবে।

মানতা নারীদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী সাইদুর রহমান পান্থ বলেন, বর্তমানে ‘এনহ্যান্সিং ইনফরমেশন অ্যান্ড ইনক্লুশন অব ফিশারফোক উইমেন, স্পেশালি দ্যা মানতা কমিউনিটি’ প্রকল্পের আওতায় ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড এবং আর্টিকেল ১৯-এর সহোযোগিতায় এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় তাদের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়া নারী জেলেরা মৎস্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি, তাদের জেলে স্বীকৃতি দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

মানতা নারীদের নিয়ে কাজ করা চন্দ্রদ্বীপ ডেভলপমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক জাহানারা বেগম স্বপ্না বলেন, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েন। ৯৩ শতাংশ নারী জেলে কোনো না কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগেন। তবুও তাদের কথা কম শোনা যায়। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাদের সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উপযোগী ব্যবস্থা নিতে হবে।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, নারী মৎস্যজীবীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। তারা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের চিহ্নিত করে দিলে তাদের কার্ড দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নারীদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে, যাতে নারীদেরও সরকারি সহায়তার আওতায় আনা যায়।