বরিশালে মান্তা সম্প্রদায় : দুর্বিষহ জীবন ধারায় মোরা এক ঘাটেতে রান্দি বাড়ি আরেক ঘাটে খাই, মোদের সুখের সীমা নাই, মোদের ঘর বাড়ি নাই। যে যাযাবর যূথচারী মানবগোষ্ঠীগুলোকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত জলবহুল-বিলবহুল-নদীবহুল অঞ্চলে দেখা যায়ে। মান্থা’রা আমাদের সমাজের এতই প্রান্তিক একটি অবস্থানে রয়েছে যে আমাদের জাতীয় পরিসংখ্যানে পর্যন্ত তাদের কোনো গুরুত্ব নেই, আমাদের জাতীয় নীতি-নির্ধারণী বৈঠকগুলোতে তাদের কথা কখনোই উঠে আসে না। মান্থা’ সম্প্রদায়ের “উন্নয়ন” নিয়ে এ পর্যন্ত কম মানুষের মাথা ব্যাথা ছিল না। তৈরি হয়েছে নিউজ প্রতিবেদন,আয়োজিত হয়েছে সেমিনার, রচিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু দিনশেষে তাদের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনার কারণে তারা আজও দারিদ্র্য ও অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত। তারা পায়না নাগরিক হিসেবে মৌলিক অধিকার , তাদের সন্তানদের “মান্থা” জনগোষ্ঠী বলে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়। মান্থা’দের উন্নয়ন দিন শেষে মানবাধিকার সচেতন সংগঠনগুলোর ফটোগ্রাফি পর্যন্ত-ই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। হয়ে ওঠেনা আর তাদের উন্নয়ন, দেখতে পায়না অন্ধকার ঘনিয়ে আলোর দেখা। বরিশালের সদর উপজেলার লাহারহাট ইউনিয়নে বসবাস করছে ৬৪ টির ও বেশী মান্থা’ পরিবার। তারা নদীরপারের নৌকায় বসবাস করে। নৌকায় ভেসে বেড়ায় ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা বাসস্থানের অভাবে কোথাও স্থায়ীভাবে থাকতে পারেনা। অধিকাংশের ই নেই জাতীয় পরিচয়পত্র। তারা ভোটাধিকার নিয়ে খুব একটা ভাবেন ও না যেখানে নুন আনতেই পান্তা ফুরায়। শীতকালে মাছ পাওয়া যায়না তখন তারা ডাংগায় চলে যায়। সেখানে শীতবস্ত্র ও কম্বলের অভাবে খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করে। তাদের সাথে কথা বলে জানা গিয়েছে কোন সরকারি অনুদান কিংবা সংস্থা থেকে সহযোগিতা তারা পায়নি এ পর্যন্ত। বিভিন্ন সংস্থা থেকে পরিদর্শনে এসে তাদের নামের তালিকা নিয়ে গেলেও অনুদান আর পৌছায়নি মান্থা’সম্প্রদায় পর্যন্ত। ১০,নভেম্বর ২০২৩ শুক্রবার লাহারহাটের মান্থা’ পল্লীতে সবচেয়ে বৃদ্ধ ব্যাক্তি আমির খানের (৬০) বক্তব্য অনুযায়ী জানা যায়, তার জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেও সে কোন নাগরিক সুবিধা পায়না। বয়স্কভাতা তো পায় ই না উলটো তাকে নদীতীরে থাকার জন্য চাঁদা দিতে হয়। তার সারাজীবন কেটেছে ভাসমান নৌকায়। তাদের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার কোন সুযোগ নেই বলে জানান। তারা খুব-ই আশাহীন এবং অসহায়। তাদের মধ্যে আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে অধিকাংশ-ই মোবাইল ফোন ব্যাবহার করেনা ও দেশের অবস্থা, ভোট সংক্রান্ত বিষয় এমনকি নিজেদের নাগরিক অধিকার নিয়ে তারা অজ্ঞ থেকে যায়। কেউ কেউ ৮ বছর থেকে শুরু করে আজন্ম ভাসমান জীবনযাপন করে যাচ্ছে। সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কথা জিজ্ঞাসাবাদে তাদের মধ্যে খুব ই হতাশার ছাপ দেখা যায়। অনেকেই এই প্রকল্প নিয়ে আস্বস্ত করলেও দিনশেষে কেউ ই কিছু করতে পারেনি তাদের জন্য। মান্থা’ সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার রক্ষার্থে সেমিনার /পরিদর্শন, ইন্টারভিউয়ের চেয়ে তাদের স্থায়ী বাসস্থান ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে দুর্নীতি নিরসনের ও প্রয়োজন আছে। সঠিক তথ্য দিয়ে তাদের করুন পরিস্থিতি তুলে ধরাটাই মুখ্য।
নুসরাত জাহান রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।